Press ESC to close

দারসুল হাদিস: হাশরের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয়প্রাপ্ত সাত শ্রেণীর মানুষ


عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ :"سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِىْ ظِلِّهِ، يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ : الإِمَامُ العَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِىْ عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِىْ المَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِىْ اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ : إِنِّىْ أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ، أَخْفَى حَتّٰى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِيْنُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ". 

সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৬৬০
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“সাত ধরনের মানুষকে আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন কোনো ছায়া থাকবে না, শুধুমাত্র তাঁর ছায়া ছাড়া।
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক
২. এমন যুবক, যিনি তার যৌবন অতিবাহিত করেছেন আল্লাহর ইবাদতে
৩. এমন ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকে
৪. দু’জন ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালোবাসে আল্লাহর জন্য, একত্র হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয় কেবল আল্লাহর জন্য
৫. এমন পুরুষ যাকে এক সুন্দরী, সম্মানিত নারী কুপ্রস্তাব দেয়, কিন্তু সে বলে, “আমি আল্লাহকে ভয় করি”
৬. এমন ব্যক্তি যে এত গোপনে সদকা করে যে ডান হাত যা দেয় তা বাম হাত জানে না
৭. এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং অশ্রু প্রবাহিত করে।”


রাবী পরিচিতি: হযরত আবু হুরাইরাহ রা.

আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ (বা আবদুর রহমান)। তিনি আযদ গোত্রের সুলায়ম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন জামার ভিতরে বিড়ালছানা বহনের কারণে রাসূল ﷺ তাঁকে মজার ছলে “আবু হুরাইরাহ” (বিড়ালের পিতা) বলে ডাকেন।
তিনি সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী, মোট হাদীস সংখ্যা: ৫৩৭৪টি।
ইসলাম গ্রহণ করেন হিজরি ৭ম বছরে। ইন্তেকাল করেন হিজরি ৫৭-৫৯ সালে এবং জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়।


হাশরের ময়দানের ভয়াবহ অবস্থা

  • হাশরের দিন মানুষ থাকবে ভীড়ের মধ্যে।

  • সূর্য থাকবে মাথার এক মাইল ওপরে।

  • শরীর ঘামে ভিজে যাবে—কারও গোড়ালি, কারও কোমর পর্যন্ত, কারও নাক অবধি।

  • সবাই থাকবে নগ্নপায়ে, নগ্নদেহে, খাতনাবিহীন অবস্থায়।

  • সেখানে কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারবে না।

এই কঠিন দিনে আল্লাহ তাআলা মাত্র সাত শ্রেণীর মানুষকে তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন।


১ম শ্রেণী: ন্যায়পরায়ণ শাসক (الإِمَامُ العَادِلُ)

  • জনগণের কল্যাণে কাজ করেন

  • আলেম ও ন্যায়বানদের সম্মান করেন

  • কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক দেশ পরিচালনা করেন

  • নিজের নেতৃত্বকে দায়িত্ব মনে করেন, গর্ব নয়

  • নবী ﷺ বলেন, “তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী ৭১৩৮)

  • নেতার কাছে জনগণের প্রতি নম্রতা ও সদাচরণ অপরিহার্য।


২য় শ্রেণী: ইবাদতশীল যুবক (وَشَابٌّ نَشَأَ فِىْ عِبَادَةِ رَبِّهِ)

  • যুবক বয়সের ইবাদত সবচেয়ে মূল্যবান

  • যুবকরা সাধারণত দুনিয়ার পেছনে ছুটে, কিন্তু কেউ যদি এই বয়সে ইবাদতে লিপ্ত থাকে, সে ব্যতিক্রম

  • শয়তান এই বয়সেই বিভ্রান্ত করে

  • হাদীস: কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে—“তোমার যৌবন কোথায় ব্যয় করেছিলে?” (তিরমিজি ২৪১৭)

  • যুবক বয়সেই দুনিয়া ও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত


৩য় শ্রেণী: মসজিদপ্রেমী মুমিন (وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِىْ المَسَاجِدِ)

  • নামাযের সময়ের অপেক্ষায় থাকে

  • জামাতে সালাত আদায়ে আগ্রহী

  • অন্তর মসজিদে থেকে যায়, যদিও শরীর বাইরে

  • এমন ব্যক্তি শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজে নামাযের পরিবেশ গড়ে তোলে

  • রাসূল ﷺ অন্ধ সাহাবীকেও জামাতে অনুপস্থিতির অনুমতি দেননি, মসজিদের গুরুত্ব প্রমাণ


৪র্থ শ্রেণী: আল্লাহর জন্য পরস্পরের ভালোবাসা (وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِىْ اللهِ)

  • একে অপরকে ভালোবাসে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য

  • সম্পর্কের ভিত্তি—ইমান, তাকওয়া, দীনদারি

  • হাদীস: “আল্লাহ যখন কাউকে ভালোবাসেন, তিনি জিবরাইলকে বলেন—‘আমি অমুককে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাসো।’” (সহীহ মুসলিম)

  • পার্থিব স্বার্থহীন ভালোবাসা–এই সম্পর্কই টিকে থাকে কিয়ামতের দিন


৫ম শ্রেণী: গুনাহ থেকে দূরে থাকা মানুষ

(وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ)

  • সুন্দরী ও মর্যাদাসম্পন্ন কোনো নারী যদি কাউকে ব্যভিচারের প্রস্তাব দেয়, আর সে বলে—“আমি আল্লাহকে ভয় করি”, সে একজন মহান ব্যক্তি।

  • এই স্তরে পাপের সুযোগ, লোভ ও প্রবণতা প্রবল হয়।

  • এমন অবস্থায় আল্লাহভীতি অবলম্বন করাই প্রকৃত তাকওয়ার পরিচয়।

  • কুরআনে আল্লাহ হযরত ইউসুফ (আ) সম্পর্কে বলেন:

    "তারা তার প্রতি কুপ্রবণতা দেখাল, কিন্তু সে বলল: আমি আল্লাহকে ভয় করি।” (সূরা ইউসুফ ২৩)


৬ষ্ঠ শ্রেণী: গোপনে সদকা প্রদানকারী

(وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا، حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ)

  • এমন ব্যক্তি গোপনে এত নিভৃতে দান করে যে বাম হাতও টের পায় না ডান হাত কী দিচ্ছে!

  • এমন দান আত্মপ্রদর্শন মুক্ত এবং একান্তই আল্লাহর জন্য হয়।

  • কুরআনে আল্লাহ বলেন:

    “তোমরা প্রকাশ্যে দান করো, ভালো; আর গোপনে করো, আরও ভালো।” (সূরা বাকারাহ ২৭১)

  • এমন দানকারী দুনিয়াতে লোক দেখাতে চান না, তাই আখিরাতে পাবেন আরশের ছায়া।


৭ম শ্রেণী: নির্জনে আল্লাহর স্মরণকারী

(وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ)

  • এমন ব্যক্তি একান্ত নির্জনে, লোকচক্ষুর আড়ালে আল্লাহকে স্মরণ করে কাঁদেন।

  • এই কান্না হয় অন্তর থেকে, আল্লাহর মহত্ত্ব ও নিজের গুনাহর উপলব্ধিতে।

  • কুরআনে বলা হয়েছে:

    "যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত পাঠ করা হয়, তারা কাঁদে এবং তাদের খুশু বৃদ্ধি পায়।” (সূরা মায়েদা ৮৩)

  • এই চোখকে জাহান্নাম স্পর্শ করতে পারবে না—হাদীস অনুযায়ী। (তিরমিযি)


উপসংহার: আমরা কী করতে পারি?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, হাশরের ভয়াবহ দিন কারো জন্য সহজ হবে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এই সাত শ্রেণীর লোককে বিশেষ আশ্রয় দেবেন। আমরা যদি এই গুণগুলো অর্জন করতে পারি, আমরাও আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পেতে পারি।

আমাদের করণীয়:

  • নিজের অবস্থান অনুযায়ী অন্তত একটি গুণ অর্জনে চেষ্টা করা

  • নিয়মিত ইবাদত, দান, মসজিদের সাথে সম্পর্ক রাখা

  • পর্নোগ্রাফি ও ব্যভিচার থেকে বাঁচা

  • আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলা

  • গোপনে নেক আমল করা

  • একাকী অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা, কাঁদা

  • যুবকদের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব, কারণ তাদের শক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে


📌 শেষ কথা

এই সাত শ্রেণী কারো জন্য সংরক্ষিত নয়। যে চেষ্টা করবে, তাকেই আল্লাহ সাহায্য করবেন।
আসুন, আমরা এখনই প্রতিজ্ঞা করি—আমার জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাজাবো, যেন কিয়ামতের ভয়াবহ দিনেও আমরা থাকি তাঁর আরশের ছায়ায়।


আল্লাহ আমাদের সবাইকে অন্তত একটি গুণ অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।