চ্যালেঞ্জসমূহ
ইবলিস বা শয়তান
আল্লাহ বলেন (সূরা আল-হিজর: ৩৯):
قَالَ رَبِّ بِمَآ أَغۡوَيۡتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَأُغۡوِيَنَّهُمۡ أَجۡمَعِينَ
[ইবলিস] বলল, "হে আমার প্রভু! আপনি যেহেতু আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমি তাদের জন্য দুনিয়ার কাজগুলোকে সুন্দর করে দেখাবো এবং অবশ্যই তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব।"
ইবলিস আমাদের চিরশত্রু। সে আল্লাহর চ্যালেঞ্জ করে বলেছে, সে মানবজাতিকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। সে আমাদের চিন্তা, মন এবং আত্মাকে প্রভাবিত করে। আমাদের প্রতিটি কাজের পূর্বে সিদ্ধান্ত আসে দুটো জায়গা থেকে: মস্তিষ্ক (চিন্তা) এবং বিবেক (আত্মা)।
মানুষ সাধারণত তিন ধরনের হয়:
- প্রথম ধরণ: মস্তিষ্ক ও বিবেক — দুটোই ইবলিস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
- দ্বিতীয় ধরণ: মস্তিষ্ক ইবলিস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু বিবেক এখনো মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণে।
- তৃতীয় ধরণ: মস্তিষ্ক ও বিবেক — দুটোই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে, এবং এরা সত্যিকার অর্থে ঈমানদার।
আমরা যেন নিজেদের তৃতীয় ধরণের মানুষ বানাতে পারি, যেখানে ইবলিসের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না — এটাই চ্যালেঞ্জ।
নিজেকে বা নিজের নফসকে জয় করা
রাসুল (সা.) বলেন:
"আমরা ছোট জিহাদ (যুদ্ধ) থেকে বড় জিহাদে ফিরলাম।"
সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন: "বড় জিহাদ কী?"
রাসুল (সা.) বললেন: "নিজের নফসের বিরুদ্ধে লড়াই।"
(আল-বাইহাকি, আল-যুহদ)
নফস হচ্ছে আমাদের অন্তরের খারাপ চাওয়া বা বাসনা। মানুষ যখন নিজের চাওয়ার দাস হয়ে যায়, তখন সে অন্যায়কে সহজে গ্রহণ করে। আমরা আমাদের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি — আরো চাচ্ছি, আরো ভোগ করতে চাই, হারাম জিনিসগুলো আমাদের কাছে সুন্দর মনে হয়।
আমরা অনেকেই অশ্লীল ভিডিও দেখি, অশালীন সিনেমা দেখি, নারীদের দিকে দৃষ্টিপাত করি, গিবত করি, চোগলখুরি করি, কথা দিয়ে কথা রাখি না — এগুলো সব নফসের দাসত্বের প্রমাণ।
একজন সাচ্চা মুসলমানের উচিত, নিজের নফসকে কুরআনের আলোয় শাসন করা, নিজের অন্তরকে আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত রাখা এবং নিজের চোখ, কান, মুখ, হাত — সব কিছু আল্লাহর বিধানের আওতায় আনতে সচেষ্ট হওয়া।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব ইত্যাদি আমাদের জীবনের বড় একটা অংশ দখল করে নিয়েছে।
আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও দেখি, অপ্রয়োজনীয় পোস্ট করি, অন্যের প্রাইভেট জীবনে উঁকি দিই। এই সবকিছু আমাদের সময় নষ্ট করে, মন নষ্ট করে, ঈমান দুর্বল করে ফেলে।
একজন মুসলিম তরুণের উচিত, সোশ্যাল মিডিয়ার সীমিত ব্যবহার এবং শুধুমাত্র দ্বীনি ও উপকারি জিনিসের জন্যই তা ব্যবহার করা।
পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব
আমাদের জীবনে যারা সবচেয়ে কাছের, যেমন — বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু — এরা অনেক সময় আমাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে দিতে পারে, যদি তারা দ্বীনি চিন্তায় দুর্বল হয়।
অনেক সময় আমরা পরিবারকে খুশি করতে গিয়ে হারাম পথে যাই। আবার বন্ধুরা যদি নাস্তিকতা, অবাধ্যতা কিংবা দুনিয়াবি প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকে, তাহলে তারাও আমাদের ঈমানকে ধ্বংস করতে পারে।
তাই আমাদের এমন বন্ধু ও পরিবারিক পরিবেশ গঠন করতে হবে, যারা আমাদেরকে মসজিদে টানে, কুরআন শিখতে উৎসাহিত করে, এবং সৎ পথে অটল থাকতে সাহায্য করে।
বিশ্বাস ও পরিচয়ের সংকট
আজকের সেক্যুলার ও বস্তুবাদী দুনিয়ায় একজন মুসলিম তরুণ নিজের ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই সংকটে পড়ে।
কেউ মুসলিম নাম শুনে প্রশ্ন তোলে, কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে, কেউ আবার নিজেই মুসলমান হয়েও গর্ব করে না।
এটা ঈমানের দুর্বলতা ও আত্মপরিচয়ের অভাব।
আমাদের উচিত, গর্ব করে বলতে: “আমরা মুসলমান”। আমরা আল্লাহর বান্দা, রাসুলের (সা.) উম্মত। আমাদের পরিচয় দুনিয়ার কোনো পাসপোর্ট নয়, আমাদের পরিচয় হচ্ছে ঈমান।
নৈতিকতা ও প্রযুক্তি
বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন আমাদের জীবনে যেমন অনেক সুযোগ এনেছে, তেমনি বড় ধরনের বিপদও নিয়ে এসেছে — বিশেষ করে নৈতিকতার ক্ষেত্রে।
আজকের তরুণেরা মোবাইল, ইন্টারনেট, ভিডিও গেম, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এবং অন্যান্য প্রযুক্তির প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে, তারা বাস্তব জীবন ও দ্বীনি চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
একজন মুসলিম তরুণের উচিত এই প্রযুক্তিগুলোকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করা। যেমন — কুরআন শোনা, ইসলামিক ভিডিও দেখা, অনলাইন দাওয়াহ করা, ইসলামিক বই পড়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে, হারাম কন্টেন্ট দেখা, গেমে ডুবে যাওয়া, পর্ণগ্রাফি দেখা, রাতভর স্ক্রল করা — এগুলো ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়।
আল্লাহ আমাদের দৃষ্টি, কান এবং হাতের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। তাই প্রযুক্তি যেন আমাদের জন্য নিয়ামত হয় — গোনাহের মাধ্যম নয়।
ইসলামফোবিয়া
ইসলামফোবিয়া মানে হলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয় বা বিদ্বেষ ছড়ানো।
আজকের পশ্চিমা বিশ্বে অনেক দেশেই মুসলমানদের টার্গেট করা হয় — কখনো পোশাকের কারণে, কখনো নামের কারণে, আবার কখনো কুরআন পড়ার কারণে।
মিডিয়া, সিনেমা এবং রাজনীতি প্রায়শই ইসলামকে সন্ত্রাস, পশ্চাৎপদতা, নারী নির্যাতন ইত্যাদির সাথে যুক্ত করে।
ফলে অনেক মুসলিম তরুণ-তরুণী লজ্জা পায় নিজের ধর্ম পরিচয় দিতে, হিজাব বা দাড়ি রাখতে দ্বিধা করে, অথবা নামটাও বদলে ফেলে।
এটা খুবই দুঃখজনক। একজন মুসলিমের উচিত সাহসের সাথে নিজের ঈমান ও পরিচয় ধরে রাখা।
রাসুল (সা.)-কে মক্কার কুরাইশরা পাগল, কবি, যাদুকর, মিথ্যাবাদী বলেছে — তবুও তিনি দ্বীন ছাড়েননি। আমরাও যেন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে গর্বের সাথে ধারণ করি।
জ্ঞান ও শিক্ষা
আমরা যখন জ্ঞান ও শিক্ষার কথা বলি, তখন সেটা কেবল দুনিয়াবি ডিগ্রি বা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য নয় — বরং দ্বীনি জ্ঞানও এর সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের তরুণরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছে, কিন্তু কুরআন পড়ে না, হাদীস জানে না, নিজের নামায ঠিকমতো পড়ে না। এ এক ধরণের ভারসাম্যহীনতা।
আল্লাহ বলেন (সূরা মুজাদালা: ১১):
"আল্লাহ তোমাদের মধ্য হতে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা অনেক উচ্চ করে দেবেন।"
আমাদের উচিত — দ্বীন ও দুনিয়া দুই ক্ষেত্রেই জ্ঞান অর্জন করা। একজন প্রকৃত মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শিক্ষক হতে পারে — তবে তাকে অবশ্যই ইসলামী আদর্শ ও নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে।
সমাজ ও রাষ্ট্র
আজকের দুনিয়া এমন একটি সমাজ তৈরি করেছে যেখানে হারাম জিনিস হালাল করে দেখানো হয়, অন্যায়কে স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলা হয়, এবং আল্লাহভীতি হাসির বিষয় বানানো হয়।
এমন সমাজে আমাদের ঈমান টিকিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন।
তাছাড়া, অনেক রাষ্ট্র ইসলামী আইন নিষিদ্ধ করে, কুরআন শিক্ষা বন্ধ করে, হিজাব নিষিদ্ধ করে এবং আলেমদের জেলে পাঠায়। এসব সমাজে তরুণেরা দ্বীন শেখার সুযোগ পায় না।
তাই একজন মুসলিম তরুণের উচিত — সমাজকে বদলানোর চেষ্টা করা। প্রথমে নিজেকে বদলানো, এরপর নিজের পরিবার, তারপর সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা।
রাসুল (সা.) ও সাহাবাদের জীবনী পড়লে আমরা দেখবো, কিভাবে তারা একটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্র বদলে দিয়েছিলেন — তাও ২৩ বছরের মধ্যে।
বিভ্রান্তি, গুজব, এবং মিথ্যা তথ্য (Misinformation)
আজকের সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এমন এক অবস্থা হয়েছে, যেখানে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন।
অনেক সময় আমরা এমন ভিডিও, ছবি বা খবর শেয়ার করি যেগুলো সম্পূর্ণ ভুল। কেউ হয়তো ইসলামের নামে ভুল ফতোয়া দেয়, কেউ আবার অন্য মুসলিমকে কাফির বলে — এসব বিভ্রান্তিকর চিন্তা আমাদের ঈমানের ক্ষতি করে।
আল্লাহ বলেন (সূরা হুজুরাত: ৬):
"হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে যাচাই করে নাও..."
আমাদের উচিত — প্রতিটি তথ্য যাচাই করা, কুরআন ও হাদীসভিত্তিক জ্ঞান গ্রহণ করা, এবং ইসলামিক স্কলারদের কাছ থেকে শিখে নিজেকে গঠন করা।
ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিন হলো মুসলমানদের প্রথম কিবলা — বাইতুল মাকদিসের ভূমি।
সেখানে বছরের পর বছর ধরে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনরা নির্যাতিত হচ্ছে, শহীদ হচ্ছে, ঘরবাড়ি হারাচ্ছে — কিন্তু মুসলিম বিশ্ব অনেকাংশেই নীরব।
তরুণদের উচিত — ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে সচেতন থাকা, দোয়া করা, দান করা, তাদের ইতিহাস ও সংগ্রাম জানা, এবং নিজেদের চিন্তায় ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা।
ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূখণ্ড নয় — এটি আমাদের ঈমানের পরীক্ষা।
আমাদের করণীয় (What We Must Do) —
ঈমান শক্তিশালী করা
একজন মুসলমানের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তার ঈমান (আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস)।
এই ঈমান যত শক্তিশালী হবে, ততই সে দুনিয়ার চ্যালেঞ্জ, গোনাহ, শয়তানের ধোঁকা এবং সমাজের চাপ মোকাবিলা করতে পারবে।
ঈমান শক্তিশালী করতে চাইলে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে, নামায প্রতিষ্ঠা করতে হবে, আল্লাহর স্মরণে থাকতে হবে, এবং সৎকাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
রাসূল (সা.) বলেন:
“ঈমান নি:সন্দেহে পুরাতন হয়ে যায়, যেমন তোমাদের কাপড় পুরাতন হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন তিনি তোমাদের ঈমান নতুন করে দেন।” (তাবারানী)
আমরা যেন এমন ঈমান তৈরি করি যা শুধু মুখের নয়, বরং অন্তরের গভীর থেকে আসে এবং আমাদের প্রতিদিনের কাজে প্রকাশ পায়।
কুরআন ও হাদীস জানা ও মানা
যেকোনো মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো আল্লাহর বাণী (কুরআন) এবং নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা (হাদীস) জানা ও মানা।
আজকের যুগে অনেক মুসলিম তরুণ টিকটক, ইউটিউব, গেমস নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে — অথচ কুরআনের অর্থ জানে না, হাদীস মুখস্ত নেই, রাসূলের জীবনী জানে না।
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক!
কুরআন হচ্ছে আল্লাহর চিঠি আমাদের প্রতি। হাদীস হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবীর জীবনচিত্র।
এই দুইটি জানলে আমাদের জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় — ক্যারিয়ার, সম্পর্ক, মানসিক স্বাস্থ্য, সমাজ, সব কিছুতেই।
আল্লাহ বলেন:
“এই কিতাব আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারো।” (সূরা ইব্রাহিম: ১)
তাই প্রতিদিন ৫-১০ মিনিট হলেও কুরআনের বাংলা অর্থ পড়া শুরু করুন, হাদীস জানুন — জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে ইনশা আল্লাহ।
নবীজির আদর্শকে অনুসরণ করা
আমরা যাকে ভালোবাসি, তাকে অনুসরণ করাই সত্যিকারের ভালোবাসার প্রমাণ।
আমরা যদি সত্যিকারের মুসলিম হতে চাই, তবে আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনকে আমাদের জীবনের মানদণ্ড বানানো।
তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতা, স্বামী, বাবা, ব্যবসায়ী, দাঈ এবং আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। তাঁর জীবনেই সব উত্তর রয়েছে।
আল্লাহ বলেন:
“তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ (Uswah Hasanah)।” (সূরা আহযাব: ২১)
তরুণদের উচিত নবীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়া — তার সাহস, ধৈর্য, দয়া, আমানতদারি, বিনয় — এই গুণগুলো নিজের মধ্যে গড়ে তোলা।
রাসূল (সা.)-এর জীবন জানুন, ভালোবাসুন, এবং অনুসরণ করুন — তবেই আপনি প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারবেন।
দ্বীনি ও দুনিয়াবি জ্ঞান অর্জন করা
ইসলাম শুধু মসজিদের ধর্ম নয় — এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।
তাই একজন মুসলমানের উচিত শুধু নামায বা রোযা শেখা নয়, বরং দুনিয়াবি ও দ্বীনি উভয় জ্ঞানে সমান পারদর্শী হওয়া।
যেমন: আপনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার, ব্যবসায়ী, শিক্ষক যা-ই হন না কেন — আপনাকে ইসলাম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে, যাতে আপনি সঠিকভাবে হালাল-হারাম বুঝতে পারেন, দ্বীনের আহ্বান করতে পারেন এবং নিজের জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরিচালনা করতে পারেন।
ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন:
"যে ব্যক্তি দুনিয়ার জ্ঞান ছাড়া দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে, সে সম্পূর্ণ মানুষ নয়; আর যে দ্বীনের জ্ঞান ছাড়া শুধু দুনিয়ার জ্ঞান অর্জন করে, সে পথহারা।"
তাই ভারসাম্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জনই একজন মুসলিম তরুণের আসল পরিচয়।
ভালো সঙ্গী ও পরিবেশ বেছে নেওয়া
আমাদের আশেপাশের মানুষই আমাদের জীবন ও চিন্তাভাবনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।
আপনি যদি আল্লাহভীরু, ইবাদতকারী, নেক বন্ধুদের সাথে থাকেন — তারাও আপনাকে জিকির, নামায, দ্বীনের পথে টেনে আনবে।
অন্যদিকে, যদি আপনি গাফেল, গোনাহে লিপ্ত, নাস্তিক বা অসৎ বন্ধুদের সাথে থাকেন — আপনি ধীরে ধীরে তার মতো হয়ে যাবেন, হয়তো টেরও পাবেন না।
রাসূল (সা.) বলেন:
“মানুষ তার বন্ধুদের দ্বীন অনুযায়ী হয়। তাই তোমরা কার সাথে বন্ধুত্ব করছো — দেখে নাও।” (তিরমিযি)
তরুণদের উচিত — এমন বন্ধু বানানো যারা দুনিয়া ও আখিরাত — উভয় দিকেই সাহায্য করে।
ইসলামিক হালকায় যোগ দিন, মসজিদের বন্ধু বানান, এবং একে অপরকে উত্তম কাজে উৎসাহিত করুন।
আপনি সাধারণ কেউ নন। আপনি একজন সম্মানিত মুসলিম।
প্রিয় তরুণ ভাই ও বোন, মনে রাখবেন — আপনি কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন। আপনি এমন এক জাতির অংশ, যার পরিচয় “মুসলিম” — অর্থাৎ আল্লাহর আজ্ঞাবহ, তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী।
আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন এবং রাসূল (সা.)-এর উম্মতের অংশ করেছেন।
এই পরিচয়ই আপনার সবচেয়ে বড় সম্মান।
আল্লাহ বলেন:
“আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি...” (সূরা ইসরা: ৭০)
তাই কখনও নিজেকে তুচ্ছ ভাববেন না। আজকের সমাজ হয়তো আপনাকে ‘cool’ মনে করবে না কারণ আপনি নামায পড়েন, ইসলাম মানেন, হিজাব পরেন, গান শুনেন না — কিন্তু জানেন, আল্লাহর কাছে আপনি সম্মানিত।
আল্লাহর দৃষ্টিতে আপনি VIP, যদি আপনি তাঁর আদেশ মেনে চলেন।
আপনি ছোট হতে পারেন বয়সে, কিন্তু দায়িত্বে বড়
তরুণরা অনেক সময় ভাবে, “আমি তো এখনো ছাত্র, আমার দায়িত্ব কী?”
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় — সবচেয়ে বড় কাজগুলো তরুণরাই করেছে।
- হযরত আলী (রা.) ছিলেন কিশোর বয়সে ইসলামের প্রথম পুরুষ মুসলিমদের অন্যতম।
- মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) মাত্র 20 বছর বয়সে মদীনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পান।
- উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি হন।
তারা ছোট ছিলো, কিন্তু আল্লাহর কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে।
তাই আপনি আজ ছাত্র হলেও — আপনারও দায়িত্ব আছে:
- নিজেকে দ্বীনের পথে রাখা,
- পরিবারকে সঠিক পথে ডাকা,
- সমাজে আলোর পথ দেখানো।
আজ যদি আপনি নিজেকে গড়ে তুলেন, আগামীর মুসলিম সমাজ আপনার মাধ্যমেই দাঁড়াবে ইনশা আল্লাহ।
সত্য পথে থাকা কঠিন, কিন্তু শেষ পরিণতি সুন্দর
জান্নাতের রাস্তা কখনোই ফুল বিছানো নয়।
এটি কষ্টকর, ত্যাগের, ধৈর্যের, আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ।
হয়তো আপনাকে নিয়ে কেউ হাসবে কারণ আপনি গান শোনেন না, হাত মিলান না, নাচ-গান পছন্দ করেন না, হিজাব পরেন — কিন্তু ভয় পাবেন না।
কারণ আপনি কার সন্তুষ্টির জন্য বাঁচছেন? মানুষের না আল্লাহর?
আল্লাহ বলেন:
“যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জীবন হবে সংকুচিত ও কষ্টকর...” (সূরা ত্বাহা: ১২৪)
আর যারা আল্লাহর পথে কষ্ট সহ্য করে, তাঁদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বিশাল পুরস্কার।
এই দুনিয়া খুবই অল্প সময়ের — কিছু চোখের পলকে চলে যাবে।
কিন্তু আপনার সব কষ্ট, সব আত্মত্যাগ আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত — এবং তিনি প্রতিটি কষ্টের বিনিময় জান্নাতে দেবেন ইনশা আল্লাহ।
আপনার সামনে এখনো সময় আছে, কিন্তু তা চিরকাল থাকবে না
আজ আপনি তরুণ, শক্তিশালী, চিন্তাশীল। কিন্তু এই সময়টা একদিন চলে যাবে।
যে ইচ্ছাশক্তি ও উদ্যম আজ আপনার আছে, ৪০ বা ৫০ বছর বয়সে সেটি আর থাকবে না।
রাসূল (সা.) বলেন:
“পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটির পূর্বে কাজে লাগাও... তার মধ্যে একটি হলো — তরুণ বয়সকে বার্ধক্যের পূর্বে।” (হাকিম)
তাই এখনই সময়:
- তওবা করার,
- দ্বীন শেখার,
- ভালো কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার,
- নিজের ভেতরের নেতিবাচকতা বদলে ফেলার।
যত দিন আছে, সেই সময়টাকে কাজে লাগান। কালকে নয়, আজই পরিবর্তনের শুরু হোক।
আপনি যদি আল্লাহর দিকে এক কদম আসেন, তিনি দশ কদম আসেন আপনার দিকে
সবচেয়ে দয়ালু, সবচেয়ে উত্তম বন্ধু হলেন আল্লাহ।
মানুষ আপনাকে ভুল করলে ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহ কখনও ছেড়ে দেন না।
রাসূল (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে এক কদম আগায়, আল্লাহ তার দিকে দশ কদম আগান।...” (মুসলিম)
আপনি যদি এখনো ভুলে থাকেন, গুনাহ করে থাকেন — সমস্যা নেই।
তওবা করুন, ফিরে আসুন। আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসবেন, সাহায্য করবেন, বদলে দিবেন আপনার জীবন।
আপনি যেমনই হোন, আল্লাহর দরজা খোলা — শুধু আপনি ফিরে আসুন।
শেষ কথা
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আপনি এক মহান দায়িত্বের বাহক — ইসলাম আপনাকে একটি লক্ষ্য দিয়েছে:
একজন আল্লাহভীরু, জ্ঞানী, আদর্শবান তরুণ হওয়া।
আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপও বড় হয়ে যাবে, যদি তা আল্লাহর জন্য হয়।
তাই:
- নিজের ভেতর আলোকিত পরিবর্তন আনুন,
- দ্বীনের আলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিন,
- এবং জীবনের প্রতিটি কাজ এমনভাবে করুন — যেন আল্লাহ খুশি হন।
আপনার পরিবর্তনই হতে পারে এই উম্মাহর ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের শুরু।