Press ESC to close

মুমিন জীবনে ইসলামী আন্দোলনের অপরিহার্যতা

 

إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلَّذِينَ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِهِۦ صَفًّۭا كَأَنَّهُم بُنْيَـٰنٌۭ مَّرْصُوصٌۭ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের (বেশি) পছন্দ করেন, যারা তার পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে, যেন তারা এক সীসাঢালা সুদৃঢ় প্রাচীর। (সূরা আস-সাফ: ৪)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে বান্দার ওপর অর্পিত অপরিহার্য পালনীয় দায়িত্ব কর্তব্যসমূহের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন অন্যতম। আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দাহ হওয়ার জন্য পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হওয়া আবশ্যক। আর ইসলামী সমাজ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ জন্য ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে ইকামতে দ্বীনের বড় ফরজটি আদায় করলে অন্যান্য ফরজ আদায় করা বান্দার জন্য সহজ হয়ে যায়।


📖 ইসলামী আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

আধুনিক আরবি ভাষায় ইসলামী আন্দোলনের প্রতিশব্দ হলো আল-হারকাতুল ইসলামিয়াহ। কিন্তু আল কুরআনের এ ক্ষেত্রে একটি নিজস্ব পরিভাষা আছে, আর তা হলো: আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ — আল্লাহর পথে জিহাদ।

আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী করা তথা ইকামতে দ্বীনের কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য যে সংগঠন সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে, তাকেই ইসলামী আন্দোলন বলা হয়। সুতরাং যে দেশে আল্লাহর আইন ও রাসূলের (সা) আদর্শ কায়েম নেই, তা কায়েমের চেষ্টাই ইসলামী আন্দোলন।


🧭 ইসলামী আন্দোলন চেনার উপায়

যে আন্দোলনের মধ্যে নিম্নোক্ত ৫টি কাজ থাকবে তাকেই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সংগঠন বা আন্দোলন বলা যাবে:


১. দাওয়াত ইলাল্লাহ

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ...
আমি নূহ (আঃ) কে তার কওমের নিকট পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর কওমকে ডাক দিয়ে বললেন, হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর- আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ: ৫৯)

وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا...
এবং আদ জাতির প্রতি আমি তাদের ভাই হুদ (আঃ) কে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বললেন, হে আমার দেশবাসী! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ: ৬৫)

وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا...
এবং সামুদ জাতির প্রতি তাদের ভাই সালেহ (আঃ) কে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বললেন, হে আমার কওমের লোকেরা! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ: ৭৩)

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا...
এবং মাদইয়ানবাসীর প্রতি তাদের ভাই শোয়ায়েব আ. কে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বললেন, হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ: ৮৫)

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ...
ডাক, তোমার রবের পথের দিকে হিকমত ও উত্তম নসীহতের সাথে। (আন-নাহল: ১২৫)

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي...
বলে দিন হে মুহাম্মদ (সা.)! এটাই একমাত্র পথ, যে পথে আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাই। (ইউসুফ: ১০৮)

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ...
হে নবী! আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শকরূপে এবং খোদার নির্দেশে তাঁর প্রতি আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। (আল-আহযাব: ৪৫-৪৬)

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا...
আর সে ব্যক্তির কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কারও হতে পারে কি, যে আল্লাহর দিকে আহবান জানায় এবং বলে: আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। (হা-মীম সাজদা: ৩৩)

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ...
তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক অবশ্যই থাকতে হবে যারা ভাল কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। (আলে ইমরান: ১০৪)


২. শাহাদাত আলান্নাস

إِنَّا أَرْسَلْنَا إِلَيْكُمْ رَسُولًا...
আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষীরূপে, যেমন ফেরাউনের নিকট পাঠিয়েছিলাম। (মুয্যাম্মিল: ১৫)

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ...
হে নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে। (আল-আহযাব: ৪৫)

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا...
এভাবে আমি তোমাদের একটি উত্তম জাতিরূপে গড়ে তুলেছি, যাতে তোমরা মানুষের জন্যে সত্যের সাক্ষী হতে পারো। (আল-বাকারা: ১৪৩)

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا...
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্যে সত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও। (আল-মায়েদা: ৮)

وَمَنْ أَظْلَمُ...
যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে, সে যদি তা গোপন করে, তাহলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? (আল-বাকারা: ১৪০)


৩. কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ

الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ...
যারা ঈমান এনেছে, তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে, আর যারা কুফরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। (নিসা: ৭৬)

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ...
ফেৎনা দূরীভূত হয়ে দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো। (বাকারা: ১৯৩)

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ...
দ্বীন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য কায়েম না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো। (আনফাল: ৩৯)

قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ...
যুদ্ধ কর আহলে কিতাবদের মধ্যে সেইসব লোকদের বিরুদ্ধে... যতক্ষণ না তারা জিযিয়া দেয় ও নত হয়। (আত-তাওবা: ২৯)

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى...
নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করেছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে—হত্যা করে ও নিহত হয়। (আত-তাওবা: ১১১)


৪. ইকামাতে দ্বীন

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ...
তিনি তোমাদের জন্য সেই দ্বীন নির্ধারণ করেছেন যা তিনি নূহ, ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসা (আ.)-কে দিয়েছিলেন — “দ্বীন কায়েম করো এবং এতে বিভক্ত হয়ো না।” (আশ-শূরা: ১৩)

الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ...
যারা পৃথিবীতে ক্ষমতা পেলে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং ন্যায় আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করে। (হাজ্জ: ৪১)


৫. আমর বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার

(পুনরুক্ত আয়াত: হাজ্জ: ৪১)


🎯 ইসলামী আন্দোলনের উদ্দেশ্য

ক. প্রাথমিক উদ্দেশ্য
– দ্বীন কায়েমের জন্য একদল ইসলামী চরিত্রসম্পন্ন আত্মনিবেদিত লোক তৈরি করা।

খ. পার্থিব প্রধান বা চূড়ান্ত উদ্দেশ্য
– আল্লাহপ্রদত্ত জীবনব্যবস্থা, রাসূলের (সা) পথ অনুসরণে মানবসমাজে কায়েম করা।
এ ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালানোর দায়িত্ব বান্দার, আর সফলতার দায়িত্ব আল্লাহর।

গ. পরকালীন উদ্দেশ্য
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জান্নাত লাভ করা।
ইসলামী আন্দোলন কোনো দুনিয়াবী লাভ বা ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে নয়, বরং তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি ইবাদত। এই আন্দোলনে যারা আত্মনিয়োগ করে, তাদের লক্ষ্য থাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজাত, রহমত এবং চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করা।


ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা


১. দ্বীনকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে

ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনের সমস্ত দিক ও ব্যবস্থা একমাত্র আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পরিচালিত করা, যেখানে কোনো ফেতনা বা শিরক থাকবে না।

আয়াত:
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌۭ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ لِلَّهِ...
"আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়..."
—সূরা বাকারা: ১৯৩


২. রাসূল ﷺ-কে পাঠানোর উদ্দেশ্য পূর্ণতা দেওয়ার জন্য

নবী ﷺ এর প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল দীনকে বিজয়ী করা—ইসলামী আন্দোলন সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ।

আয়াত:
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُ...
"তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দীনসহ, সকল দীনকে বিজয়ী করার জন্য..."
—সূরা তাওবাহ: ৩৩ / সূরা ফাতহ: ২৮ / সূরা সফ: ৯


৩. নির্যাতিত মানবতার মুক্তির জন্য

জুলুম ও নির্যাতনের শিকার মানুষদের মুক্ত করা ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম দায়িত্ব।

আয়াত:
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ...
"তোমরা কেন যুদ্ধ করছ না আল্লাহর পথে এবং নির্যাতিত নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য যারা আহ্বান জানায়: হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এই জালিম নগর থেকে মুক্ত করুন..."
—সূরা নিসা: ৭৫


৪. মানবতার হিদায়াত ও নৈতিক সংস্কারের জন্য

ইসলামী আন্দোলনের কাজ হলো সমাজকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধের মাধ্যমে কল্যাণের দিকে আহ্বান করা।

আয়াত:
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌۭ...
"তোমাদের মধ্যে এমন এক দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করে..."
—সূরা আলে ইমরান: ১০৪ / ১১০


৫. দুনিয়াবাসীর ওপর সাক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য

মুসলমানদের কাজ হলো মানবজাতির উপর সত্যের সাক্ষ্য বহন করা এবং রাসূল ﷺ এর অনুসারী হিসেবে তার সাক্ষ্যকে জিইয়ে রাখা।

আয়াত:
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَـٰكُمْ أُمَّةًۭ وَسَطًۭا...
"আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতি করেছি যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হন..."
—সূরা বাকারা: ১৪৩


৬. আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ পালন করার জন্য

আল্লাহ আমাদেরকে স্পষ্টভাবে জিহাদ বা সংগ্রামের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

আয়াত:
وَقَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ...
"তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো এবং জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।"
—সূরা বাকারা: ২৪৪ / সূরা তাওবাহ: ৪১


৭. অপছন্দনীয় হলেও দায়িত্ব পালন আবশ্যক

সংগ্রাম বা জিহাদ অনেক সময় কষ্টদায়ক ও অপছন্দনীয় হলেও, ইসলামী আন্দোলনের কাজ থেকে সরে আসা চলবে না।

আয়াত:
كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌۭ لَّكُمْ...
"তোমাদের জন্য যুদ্ধ নির্ধারিত করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের অপছন্দ। হতে পারে, তোমরা যা অপছন্দ করো, তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর..."
—সূরা বাকারা: ২১৬


৮. আল্লাহর আজাব থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের জন্য

ইসলামী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করলে পাপ মোচন হয় এবং জান্নাত লাভের আশ্বাস রয়েছে।

আয়াত:
هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَـٰرَةٍۢ تُنجِيكُم...
"আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার কথা বলবো যা তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে?..."
—সূরা সফ: ১০-১২


৯. আল্লাহর সাথে মুমিনদের চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য

মুমিনরা আল্লাহর সাথে জান্নাতের বিনিময়ে নিজেদের জান-মাল বিক্রি করেছে। এই চুক্তি পূর্ণতা পায় ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে।

আয়াত:
إِنَّ ٱللَّهَ ٱشْتَرَىٰ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ...
"আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে..."
—সূরা তাওবাহ: ১১১


১০. খিলাফতের দায়িত্ব পালন করার জন্য

মানুষকে আল্লাহ দুনিয়ায় খলিফা বানিয়েছেন, তার বিধান কায়েম করে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করাই ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

আয়াত:
إِنِّي جَاعِلٌۭ فِى ٱلْأَرْضِ خَلِيفَةًۭ...
"আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি (খলিফা) সৃষ্টি করতে যাচ্ছি..."
—সূরা বাকারা: ৩০


১১. দুনিয়ার নেতৃত্ব অযোগ্যদের হাতে চলে যাবে

যদি মুসলমানরা আল্লাহর দীন কায়েমের দায়িত্ব না নেয়, তাহলে নেতৃত্ব অন্যদের হাতে চলে যাবে যারা মানবজাতিকে গোমরাহিতে ডুবিয়ে দেবে।

আয়াত:
وَكَذَٰلِكَ نُوَلِّى بَعْضَ ٱلظَّـٰلِمِينَ بَعْضًۭاۢ بِمَا كَانُوا۟ يَكْسِبُونَ
"এভাবে আমি কিছু জালিমকে অন্য কিছু জালিমের উপর ক্ষমতা দিই, তাদের কৃতকর্মের কারণে।"
—সূরা আন‘আম: ১২৯


১২. মুমিনরা পরীক্ষায় পতিত হবে

ইসলামী আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে যদি কেউ চুপ থাকে, তবে আল্লাহ তাদেরকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করবেন।

আয়াত:
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تُتْرَكُوا...
"তোমরা কি মনে করো তোমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে, অথচ আল্লাহ এখনো জানেননি তোমাদের মধ্য থেকে কে তাঁর পথে জিহাদ করে এবং কে ধৈর্যধারণ করে?"
—সূরা আলে ইমরান: ১৪২


১৩. জাহিলিয়াত সমাজে আধিপত্য বিস্তার করবে

যদি ইসলামী আন্দোলন না থাকে, তাহলে অজ্ঞতা, অন্যায়, শিরক, দুনিয়াপূজা সমাজে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।

আয়াত:
أَفَحُكْمَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَ...
"তারা কি জাহিলিয়াতের শাসনই চায়? আর আল্লাহর চাইতে উত্তম বিধানদাতা আর কে আছে, সে জাতির জন্য যারা দৃঢ়বিশ্বাসী?"
—সূরা মায়েদা: ৫০


১৪. আল্লাহর গজব নেমে আসবে

ইসলামী আন্দোলন অবহেলা করা মানেই আল্লাহর রহমত হারানো ও গজবকে ডেকে আনা।

আয়াত:
وَاتَّقُوا۟ فِتْنَةًۭ لَّا تُصِيبَنَّ ٱلَّذِينَ ظَلَمُوا۟ مِنكُمْ خَآصَّةًۭ...
"আর এমন একটি ফিতনা থেকে বাঁচো যা তোমাদের মধ্যে শুধু জালিমদেরই স্পর্শ করবে না।"
—সূরা আনফাল: ২৫


১৫. দ্বীনের ক্ষতি হলে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থতা

ইসলামী আন্দোলন ব্যর্থ হলে দ্বীনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এবং মুসলমানরা সম্মান হারায়।

আয়াত:
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ ٱلْإِسْلَـٰمِ دِينًۭا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ...
"যে কেউ ইসলামের বাইরে অন্য কোনো দীন গ্রহণ করে, তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন।"
—সূরা আলে ইমরান: ৮৫


ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও মর্যাদা :

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বাণীসমূহে ইসলামী আন্দোলন তথা আল্লাহর পথে জিহাদের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

১. আল্লাহর পথে ধুলোয় মলিন পা:
হযরত আবু আব্বাস (রা) বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, “যার দুই পা আল্লাহর পথে ধুলোমলিন হয়, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।”
📚 সহীহ বুখারি, তিরমিজি, নাসায়ী

২. সর্বোত্তম আমল:
হযরত আবু যার গিফারি (রা) বলেন, আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! কোন আমল সবচেয়ে উত্তম?”
তিনি বললেন, “আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং তার পথে জিহাদ।”
📚 সহীহ মুসলিম

৩. এক সকাল বা সন্ধ্যা জিহাদে:
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর পথে একটি সকাল বা একটি সন্ধ্যা ব্যয় করা দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।”
📚 সহীহ বুখারি

৪. অবিরাম ইবাদতের তুলনা:
হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, “জিহাদে অংশগ্রহণকারী ঐ ব্যক্তির মতো, যে অবিরাম রোজা রাখে ও নামাজ পড়ে।”
📚 সহীহ বুখারি

৫. দ্বীনের চূড়ান্ত চূড়া:
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, “দ্বীনের মূল ইসলাম, খুঁটি নামাজ এবং সর্বোচ্চ চূড়া হলো আল্লাহর পথে জিহাদ।”
📚 মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ

৬. সামান্য সময়ও মূল্যবান:
হযরত মুয়াজ (রা) বলেন, নবী (সা) বলেছেন, “যে মুসলিম ব্যক্তি উটের দুধ দোহনের সময় পরিমাণ আল্লাহর পথে লড়াই করে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়।”
📚 তিরমিজি

৭. ধুলোয় মলিন পা ও জাহান্নাম হারাম:
হযরত আবায়া ইবনে রিফায়া (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর পথে যার পা ধুলোয় মলিন হলো, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।”
📚 সহীহ বুখারি

৮. আঘাতপ্রাপ্ত যোদ্ধার মর্যাদা:
হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর পথে আহত ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আসবে, তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরবে—রঙ হবে রক্তের মতো আর ঘ্রাণ হবে মিশকের মতো।”
📚 সহীহ বুখারি


ইসলামী আন্দোলন না করার পরিণাম:

১. কুরআনের অংশবিশেষ মানা আর অংশবিশেষ অমান্য করলে অপমান ও কঠিন আযাব:

“...তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনো আর কিছু অস্বীকার করো? যারা এমন করে, তাদের জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা আর কিয়ামতের দিন কঠিনতম শাস্তি।”
📖 সূরা আল-বাকারা: ৮৫

২. আল্লাহর হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া:

“...যদি আল্লাহ ও রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ তোমাদের কাছে প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত। আল্লাহ পাপাচারী জাতিকে হেদায়াত দেন না।”
📖 সূরা তাওবাহ: ২৪

৩. আখেরাতে কঠিন শাস্তি:

“তোমরা যদি (আল্লাহর পথে) বের না হও, আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দিবেন এবং অন্য জাতিকে তোমাদের জায়গায় আনবেন।”
📖 সূরা তাওবাহ: ৩৯

“...তারা বলল গরমের মধ্যে বের হবে না। বল, জাহান্নামের আগুন তো আরও গরম।”
📖 সূরা তাওবাহ: ৮১

৪. ইসলামী আন্দোলনের চিন্তাও না থাকলে মৃত্যু হবে মুনাফিকের মৃত্যু:
হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি ইসলামী আন্দোলন করেনি, এমনকি এর চিন্তাও করেনি, সে যেন মুনাফেকি অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলো।”
📚 সহীহ মুসলিম

৫. সৎ লোকের দোয়াও কবুল হবে না:
হযরত হুযায়ফা (রা) বলেন,

“তোমরা যদি অন্যায় প্রতিরোধ না করো, আল্লাহ তোমাদের মাঝে সবচেয়ে পাপীকে শাসক বানিয়ে দেবেন। তখন তোমাদের সৎ লোকের দোয়া ও কান্নাকাটি কবুল হবে না।”
📚 মুসনাদে আহমদ

হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন,

“যদি তোমরা অন্যায় প্রতিরোধ না করো, এক সময় আল্লাহ তোমাদের দোয়ায় সাড়া দেবেন না, তোমরা চাইলে দিবেন না, সাহায্য চাইলে সাহায্য করবেন না।”
📚 মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ


ইসলামী আন্দোলনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক

ইসলামী আন্দোলন একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি দাওয়াতি ও রূপান্তরমূলক কার্যক্রম। এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একে অন্যান্য আন্দোলন থেকে আলাদা করে। এখানে ইসলামী আন্দোলনের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:


১. ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন

সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও পারস্পরিক সহানুভূতির বন্ধন অত্যন্ত মজবুত হওয়া চাই। ইসলামী আন্দোলনের শক্তি এই ঐক্যেই নিহিত।

القرآن:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে কাতারবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে, যেন তারা একটি সীসাঢালা সুদৃঢ় প্রাচীর।”
📖 সূরা আস-সাফ: ৪


২. দায়িত্বশীল ও কর্মীদের মধ্যে সুশৃঙ্খল কর্মসম্পাদন

যেমন একটি গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলে সমস্ত অংশ একযোগে কাজ করে, তেমনি ইসলামী আন্দোলনের প্রত্যেক দায়িত্বশীল ও কর্মীর মাঝে সমন্বয়, নিয়মানুবর্তিতা ও সজাগতা থাকা অপরিহার্য। সকলের একক মনোযোগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আন্তরিকতা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়।


৩. পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ (শূরা)

ইসলামী আন্দোলনে মতামত গ্রহণ, আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক। এতে সাওয়াব বাড়ে, ভুলের আশঙ্কা কমে যায়, আর ভুল হলেও একক কেউ দায়ী থাকে না। এটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নতও বটে।

القرآن:
“তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে, এবং কল্যাণমূলক কাজে অগ্রাধিকার নেয়। তারাই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।”
📖 সূরা আলে ইমরান: ১০৪

“যারা তাদের রবের আহ্বানে সাড়া দেয়, সালাত কায়েম করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে এবং আমি যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।”
📖 সূরা আশ-শূরা: ৩৮


৪. ইহতিসাব – পারস্পরিক সংশোধনের পরিবেশ

ইহতিসাব মানে হল—ভ্রাতৃপ্রতিম পরিবেশে গিবত না করে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ভাইয়ের ভুল pointing out করা, যাতে সে সংশোধনের সুযোগ পায়। এটা ইসলামী আন্দোলনের সুস্থ সংস্কৃতি গঠনে সহায়ক।


৫. আত্মসমালোচনার অভ্যাস

আত্মসমালোচনা হলো উন্নতির সিঁড়ি। এতে অহঙ্কার দূর হয়, নিজের ভুল ধরতে শেখা যায়, চরিত্রে উন্নতি আসে এবং নেতৃত্ব ও দায়িত্ব পালনে পরিপক্বতা অর্জিত হয়।


ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য ৪টি ব্যক্তিগত গুণ অপরিহার্য:

১. ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান:

  • ইসলাম কী, কেন, এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হয়—এসব বিষয়ে পরিষ্কার ও গভীর ধারণা থাকতে হবে।

২. ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাস (ঈমান):

  • সকল পরিস্থিতিতে ইসলামের সত্যতার প্রতি দৃঢ় আস্থা রাখা।

৩. ইসলামী চরিত্র ও আমল:

  • নিজের জীবন ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত করা।

৪. ইকামাতে দ্বীনকে জীবনের মূল লক্ষ্য মনে করা:

  • শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাকেই মূল জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করা।


শেষ কথা

আল্লাহর রাসূল (সা) যখন প্রথম ওহি পেলেন, তখন তিনি বিশ্রামে যাওয়ার পরপরই আল্লাহ তাকে হুকুম করলেন:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلْمُدَّثِّرُ، قُمْ فَأَنذِرْ، وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ
“হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী! ওঠো, সতর্ক করো, আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।”
📖 সূরা মুদ্দাসসির: ১-৩

নবী (সা) ওহি পাওয়ার পর বিশ্রাম নেননি, বরং পুরো জীবনের সমর্পণ ঘটিয়েছেন ইসলামী দাওয়াত ও সংগ্রামে। সুতরাং আমাদের বসে থাকার সময় নেই। ইসলামী আন্দোলন কেবল একটি দায়িত্ব নয়, বরং ঈমানের দাবিও বটে।

✊ আসুন, আমরা সবাই ইসলামী আন্দোলনের মহান কাজে ঐক্যবদ্ধ হই, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি, এবং আখেরাতে মুক্তির যোগ্যতা লাভ করি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *